দু’ বছর পরে আবার স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস ফিরে এসেছে বাচ্চাদের মধ্যে ৷ এখন তো গরমের ছুটি চলছে ৷ এর পর আবার শুরু হবে ক্লাস৷ দীর্ঘ অদর্শনের পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়ে ওদের ভাল লাগছে ঠিকই ৷ আবার অনেকেরই স্কুল নিয়ে ভীতি বা আতঙ্কও দেখা দিয়েছে ৷ সেই ভীতি কাটানোর জন্য বাবা মায়েরা কী করবেন ?
সুপর্ণা ঘোষ : একটা মিক্সড ফিলিং বা মিশ্র অনুভূতি হয়েছে৷ প্রথমত বন্ধুদের সঙ্গে আবার দেখা হচ্ছে, গল্প হচ্ছে, একসঙ্গে খেলছে-এ সব তো স্কুলজীবনের মজার অঙ্গ৷ কিন্তু একইসঙ্গে আবার রেজিমেন্টেশনও ফিরে এসেছে৷ অনলাইন ক্লাসে তো আর অত শত নিয়ম মানা হয়নি৷ এখন আবার সেই সকালে উঠে তৈরি হওয়া, স্কুলে যাওয়া-সেই কঠোর রুটিন আর মানতে চাইছে না বা পারছে না বাচ্চারা৷
সেইসঙ্গে পড়াশোনার চাপ ও ফিরে এসেছে৷
সুপর্ণা ঘোষ : হ্যাঁ, ভীতির দ্বিতীয় কারণ সেটা৷ কোভিডের জন্য পড়াশোনার সিস্টেমে ছন্দোপতন হয়েছে, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই৷ প্রাথমিক থেকে শুরু করে উঁচু ক্লাস অবধি, পড়ুয়াদের ক্ষতি হয়েছে৷ এই যে অভ্যাসে ছন্দোপতন, এর ফলে একটা আতঙ্ক গ্রাস করেছে ওদের৷ নিজেদের সীমাবদ্ধতা নিয়ে ওরা ভাবছে৷ নিজেদেরই প্রশ্ন করছে-আমরা কি পারব? এই যে ভীতি, এটা নিয়ে কাউকে বলতেও পারছে না৷ আবার নিজের ভিতরে রাখতেও পারছে না৷ বিশেষ করে ১৩-১৪ বছর বয়সি বাচ্চারা তো রীতিমতো আতঙ্কে ভুগছে৷ ফলে কী হচ্ছে, ছোট বাচ্চাদেরও অ্যাংজাইটি বা আতঙ্ক গ্রাস করছে৷ এটা আমরা আগে দেখিনি৷ কিন্তু এখন দেখছি৷
এই ভীতি বা আতঙ্ক মনের ভিতরে চেপে রেখেও বোধহয় জটিলতা বাড়ছে?
সুপর্ণা ঘোষ : একদমই তাই৷ মনের মধ্যে তৈরি হওয়া ভীতি, আতঙ্ক, উদ্বেগ সব কিছুই বার করে দেওয়ার বা ভাগ করে নেওয়ার জন্য কিন্তু বাচ্চার একটা জায়গা চাই৷ সেটা বাবা মা হতে পারেন, আত্মীয়দের মধ্যে কেউ হতে পারেন, অনাত্মীয় কেউ হতে পারেন৷ আবার স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকাও হতে পারেন৷ যাঁদের কাছে মনের কথা খুলে বলতে পারবে৷ তবে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করলে হবে না কিন্তু৷ কারণ তারা নিজেরাও উদ্বেগের শিকার৷
আরও পড়ুন : কোভিডে প্রিয়জনকে হারানোর দুঃখ নিয়েই বসতে হচ্ছে মাধ্যমিকে? মন শক্ত করার উপায় বললেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
বাচ্চা যাঁকে নিজের সমস্যার কথা বলবে, তাঁর আশু কর্তব্য কী হবে?
সুপর্ণা ঘোষ : প্রথমেই বলব সদর্থক কথা বলতে হবে বাচ্চাকে৷ হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে৷ বলতে হবে, হ্যাঁ ঠিক আছে৷ প্রথম একটা দু’টো পরীক্ষা খারাপ হতেই পারে৷ কিন্তু তুমি ঠিক পারবে৷ বাবা মাকেও বুঝতে হবে, ওদের অভ্যাসটা চলে গিয়েছিল৷ তাই মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দিতেই হবে৷ আমরা বড়রাই পারি না৷ আর ওরা তো ছোট৷ ১৮ বছরের নীচে সকলেই কিন্তু আমাদের কাছে চাইল্ড৷
স্কুলেরও তো কিছু ভূমিকা থাকে এ বিষয়ে?
সুপর্ণা ঘোষ : নিশ্চয়ই৷ এখন তো সব স্কুলেই কাউন্সেলর থাকেন৷ তাঁদের সঙ্গে কথা বলা৷ একটু ফ্লেক্সিবিলিটি আনা৷ হাইব্রিড মোডে ক্লাস করা যায় কিনা, সেটা বিবেচনা করা৷ ক্লাসের সংখ্যা কমানো যায় কিনা-এগুলো একটু বিবেচনা করতে হবে৷ সিলেবাস তো শেষ করতেই হবে৷ কিন্তু তার মাঝেই ফ্লেক্সিবিলিটির কথা ভাবতে হবে৷ শুধু কনটেন্টের বোঝা না চাপিয়ে কনশাস এডুকেশন বা সচেতন শিক্ষা দিতে হবে৷ কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিজে গুরুত্ব দিতে হবে৷ গত দু’ বছর পড়ুয়ারা কোন পরিস্থিতির মধ্যে কাটিয়েছি, সেটা বিবেচনা করে স্কুল যদি একটু সহানুভূতিশীল জায়গায় থাকে, তাহলে আমার মনে হয় ভাল হবে৷
ভাগ করে নেওয়ার পরও যদি বাচ্চার মনের সমস্যা না কাটে, তাহলে তো আপনাদের কাছে যেতেই হবে?
সুপর্ণা ঘোষ : একটুও সময় নষ্ট না করে আসতে হবে৷ মনোবিদের কাছে যাওয়া মানেই লোকে পাগল ঠাওড়াবে-এমন ধারণা কিন্তু আগের থেকে অনেকে পাল্টেছে৷ একটু বড় পড়ুয়ারা নিজেরাই আমাদের কাছে আসে সমস্যা নিয়ে৷ ছোটদের ক্ষেত্রে বাবা মাকে অগ্রণী হতে হবে৷ গত ধরা রীতি থেকে বেরিয়ে অন্য ভাবে পড়াশোনা করা যায় কিনা, সেটা দেখতে হবে৷
আরও পড়ুন : ‘ক্রনিক রেসপিরেটরি ডিজিজে বছরভর এড়িয়ে চলুন ফ্রিজের ঠান্ডা খাবার এবং ঠান্ডা জলে স্নান’
বাচ্চারা তো এমনিতেই বড়দের তুলনায় অনেক বেশি ফ্লেক্সিবল?
সুপর্ণা ঘোষ : সে তো নিশ্চয়ই৷ এখন সত্যিই ওদের অসুবিধে হচ্ছে৷ তবে ছ’ মাসের মধ্যে ওরা এটা কাটিয়ে উঠবে৷ তাছাড়া এই পরিস্থিতিতে আরও যেটা দরকার, তা হল প্রয়োজনীয় হল পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া৷ প্রয়োজনীয় পুষ্টি যেন ডায়েটে থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে৷ সেটা শারীরিক ও মানসিক, দু দিকেই খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ কারণ বাচ্চাদের তো মস্তিষ্কের বিকাশ এখনও সম্পূর্ণ হয়নি৷ সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ডি যেন পায়, খেয়াল রাখতে হবে সেদিকেও৷
এত দিন পর বাড়ির বাইরে এত ক্ষণ থাকছে, সেটাও তো বাচ্চাদের মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে?
সুপর্ণা ঘোষ : আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি–কলকাতার নামী এক স্কুলের ক্লাস এইটের পড়ুয়া গরমের ছুটির আগে স্কুলই করতে পারছিল না৷ কারণ সে বাড়িতে সব সময় বাতানুকূল পরিবেশে থাকছিল৷ স্কুলে গিয়ে এসি ছাড়া আর থাকতেই পারছিল না! কলকাতার বেশির ভাগ স্কুলেই এখনও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্লাসরুম নেই৷ আমি এরকমও শুনেছি বাচ্চাদের হিটস্ট্রোক, সানস্ট্রোক হয়েছে৷ এটা স্কুলকেও বুঝতে হবে৷ বাবা মাকেও বুঝতে হবে৷
বাবা মা কি ওভার প্রোটেক্টিভ হয়ে আখেরে সন্তানের ক্ষতি করে ফেলেন? কারণ বাবা মায়ের শৈশবে কিন্তু বাতানুকূল যন্ত্রের এত চল ছিল না৷ কিন্তু সন্তানের একটু গরম লাগলেই তাঁদের মনে হয় রসাতলে গেল!
সুপর্ণা ঘোষ : একদমই তাই৷ যাঁর মেয়ের সমস্যার কথা বলছি, তাঁর মা-ই সেকথা বলেছেন৷ যে, তাঁদের ছোটবেলায় সারারাত লোডশেডিং ছিল৷ তার পরেও সকালে উঠে ঠিক সময়ে স্কুল গিয়েছেন৷ কিন্তু তাঁর সন্তান পারছে না৷ ফলে বাবা মাকে একটু মোটিভেট করতেই হবে৷
আরও পড়ুন : অন্তঃসত্ত্বারা এবং নতুন মা যাঁরা স্তন্যপান করাচ্ছেন, তাঁরা কি টিকা নেবেন? দ্বিধা দূর করলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক
বর্তমানে অণু পরিবারে বোধহয় বাচ্চাদের ঘিরে সুরক্ষা আরও বাড়ছে?
সুপর্ণা ঘোষ : অবশ্যই তাই৷ সেইসঙ্গে ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে গিয়েছে অনেকটাই৷ উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা মা দু’জনেই উপার্জন করছেন মোটা বেতন৷ সন্তানের সঙ্গে যথেষ্ট সময় কাটাতে পারছেন না৷ সেই অপরাধপ্রবণতা দূর করছেন ভোগ্যপণ্যের সমাহারে৷ বাচ্চাদের হাতে এখন আইপ্যাড! সন্তানকে কিন্তু শারীরিক ও মানসিক শ্রমের দিকে কিছুটা এগিয়ে দিতে হবে৷ বাচ্চাকে তো শিখতে হবে৷ বাচ্চা একটু ফ্রাস্টেশনের মধ্যে দিয়ে গেলে কিন্তু ক্ষতি নেই৷ তাতে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে৷
বন্ধুদের দেখেও কিন্তু বাচ্চাদের মধ্যে চাহিদা তৈরি হয়৷ এখন বাচ্চাদের জন্মদিনের পার্টি মানে কোনও থিম!
সুপর্ণা ঘোষ : এ বার যে বাচ্চার বাবা মা সেটা দিতে পারছে না, তাঁদের সন্তানের মনের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে৷ আমি বাবা মায়েদের বার বার বলছিল বাচ্চাকে একটু কষ্ট করতে দিন৷ না হলে কিন্তু ওরা জীবনে লড়তে পারবে না৷ সমস্যা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না৷
এখন তো বাচ্চারা প্রায় বাবল-এর মধ্যে বড় হয়?
সুপর্ণা ঘোষ : পুরো প্রোটেকটিভ বাবল-এর মধ্যে বেড়ে ওঠে৷ বিশেষ করে উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তদের মধ্যে এটা দেখা যায়৷ এতে কিন্তু বাচ্চার খুব ক্ষতি হয়৷ আমি তো বলব, বাচ্চাকে দোকানে পাঠান৷ ওকে নিজেকে হিসেব করে জিনিস কিনতে বলুন৷ কিন্তু যথেচ্ছ খরচ নয়৷ বাবা মায়ের কার্ড নিয়ে বাচ্চা নিজে জিনিস কিনছে, তা যেন না হয়৷ বরং সন্তানকে বুঝতে হবে অর্থোপার্জন করতে বাবা মাকে কতটা কষ্ট পেতে হয়৷
উল্টে বাবা মা ভাবছেন আমরা শৈশবে যা পাইনি, তা যেন আমার সন্তান পায়৷
সুপর্ণা ঘোষ : এটাও যেমন আছে, আবার অন্যদিকে হয়তো ভয়ানক শাসন করছেন৷ সেটাও ক্ষতিকর৷ এতে বাচ্চার আত্মমর্যাদা বিঘ্নিত হয়৷ আবার অন্যদিকে অকাতরে দিয়ে দেওয়াও বিপজ্জনক৷ ফলে বাবা মায়ের আচরণে একটা ভারসাম্য দরকার৷
আর একটা প্রসঙ্গে আসছি৷ কোভিডে প্রিয়জনকে হারানো ব্যথা থেকে হয়তো কোনও বাচ্চা বার হতে পারছে না৷ সেক্ষেত্রে কী হবে?
সুপর্ণা ঘোষ : শুধু কোভিড বলে নয়৷ যে কোনও শোকের চারটে ধাপ আছে৷ প্রথম ধাপে আসে অস্বীকার৷ শোককে মেনে নিতে চায় না৷ এর পর রাগ৷ কেন সে এই শোকের শিকার হল, এই প্রশ্ন আসে৷ তার পর সে ভাবতে থাকে-আচ্ছা এই পর্ব কাটিয়ে ফেললে আমি ওটা করব৷ এর পর চূড়ান্ত পর্ব হল ডিপ্রেশন৷ বাচ্চা একদম চুপ করে যায় তখন৷ এই সব ধাপ পার হলে আসে অ্যাকসেপ্টেন্স৷ এই ধাপগুলো কার ক্ষেত্রে কতটা স্থায়ী হবে, তা নির্ভর করে পারিপার্শ্বিকের উপর৷ এই এনভায়রনমেন্টাল সাপোর্ট দিতে হবে৷ ওদের শোকের বহিঃপ্রকাশের ভাষা বুঝতে হবে৷ এর কোনও শর্টকাট নেই৷ শোকের ভিতর দিয়ে গিয়েই শোক মেনে নিতে হবে৷ এ ছাড়া কোনো সুইচ অফ, সুইচ অন পদ্ধতি নেই৷ বাচ্চার চারপাশে যাঁরা আছেন, তাঁদের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ৷
বাচ্চারা তো কাউন্সেলিংয়ের জন্য যায়৷ ওদের কিছু বলবেন?
সুপর্ণা ঘোষ : বলব, তোমাদের মনে যা কিছু কষ্ট, সে গুলো চেপে না রেখে খুলে বলো৷ মনঃসংযোগ করো৷ নিজের যা হবি, সেটা নিয়ে বেশি সময় কাটাও৷ তবে মোবাইল, ল্যাপটপ থেকে দূরে থাকো৷ এত দিন উপায় ছিল না, করেছো৷ কিন্তু এখন খোলা হাওয়ায় বেরিয়ে এসো৷
আর অভিভাবকদের কী বলবেন?
সুপর্ণা ঘোষ : বাচ্চার স্বাস্থ্যের দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন৷ কিন্তু ওদের একটু জীবনের প্রতি এক্সপোজড হতে দিন৷ আর বাচ্চার সমস্যার সমাধান করতে হলে তাদের জায়গায় গিয়ে, সমস্যাটা বুঝে তার পর সমাধান করুন৷ বাবা মাকেই আগে শিখতে হবে৷ দরকার হলে পেরেন্টিং কোর্স করুন৷ বাচ্চাকে বোঝান, সে ভাল কাজ করার জন্য এই পৃথিবীতে এসেছে৷ ভাল কাজ মানেই সব সময় মন দিয়ে পড়াশোনা নয়৷ বাচ্চাকে ভাল মানুষ হয়ে উঠতে উৎসাহ দিন৷
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।