#কলকাতা: কালীপুজো মানেই আরামদায়ক ঠান্ডা পড়া শুরু। আমাদের মতো দেশে সে বড় সুখের সময়। কিন্তু একটা ঋতু থেকে অন্যটার দিকে যাত্রা। একেই ইংরেজি পরিভাষায় বলে সিজন চেঞ্জ। আর এই সিজন চেঞ্জের ফল তো প্রায় প্রত্যেক ঘরেই প্রকট। শিশু হোক বা বয়স্ক। আবহাওয়ার পরিবর্তনে, তাপমাত্রার পরিবর্তনের প্রভাব অনেকেরই শরীর জানান দেয়। এই সময়েই বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ কমে যায়। আর ড্রাই ওয়েদার শুরু। কিন্তু এরই সঙ্গে আসে কিছু শারীরিক জটিলতা। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে। আর তা থেকে মুক্তি পেতে কী কী করণীয়, তা জানালেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ড. নন্দিতা সাহা। কথা বললেন তিস্তা রায় বর্মণ।
প্রশ্ন: এই সময়ে শিশুরা কী রকম উপসর্গ নিয়ে আসে আপনার কাছে?
ড. নন্দিতা: বিভিন্ন উপসর্গ দেখেছি। কখনও শারীরিক, কখনও আবার মানসিকও। শরীরে যা যা উপসর্গ দেখা যায়, তা হল ফ্লু অর্থাৎ ঠান্ডা লাগা, জ্বর, গলায় কষ্ট, নাকে জ্বালা, বা কানে ব্যথা, পেট খারাপ, অ্যালার্জি, বমি, ত্বকে র্যাশ, চোখ লাল, চোখ থেকে জল পড়া ইত্যাদি। কখনও কখনও বাচ্চারা নিজেদের শারীরিক সমস্যার কথা বাবা-মাকে বোঝাতে পারে না বলে খিটখিটে বা বদমেজাজি হয়ে পড়ে। বাবা-মা এসে মাঝেমাঝে জানান, তাঁদের সন্তান বদমেজাজি হয়ে উঠেছে, বা খাবার খেতে চাইছে না, স্কুল যেতে চায় না, তখন পরীক্ষা করে দেখা যায়, আসলে তার শরীরে ভাইরাল ইনফেকশন বা অ্যালার্জি রয়ে রয়েছে, তাই বাইরে ওরকম প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
প্রশ্ন: আপনি অভিভাবকদের কী কী পরামর্শ দেন?
ড. নন্দিতা: প্রথম বার কোনও বাচ্চাকে দেখলে একটু সময় লাগে তার মেডিক্যাল হিস্ট্রি বুঝতে। যে বাচ্চাকে আমি অনেকদিন ধরে দেখছি, তার সমস্যাগুলো আমার জানা। কয়েকটা পয়েন্ট বললে সুবিধা হবে।
প্রথমত, যে বাচ্চা বারবার আসে, তার ক্ষেত্রে আলাদা চিকিৎসা। আমাকে দেখতে হয়, তার অন্য কোনও সমস্যা তৈরি হয়েছে কিনা। সেটা হয়তো কেবল সিজনাল প্রবলেম নয়। শরীরে কোনও অ্যালার্জি রয়েছে, সিজন চেঞ্জে সেটা বেড়ে যাচ্ছে। তখন বিশেষ রক্তপরীক্ষা করাতে হবে।
দ্বিতীয়ত, ভ্যাক্সিনেশন। যে বাচ্চা সমস্ত ভ্যাক্সিন নিয়ে নিয়েছে, তার রোগের তীব্রতা কম হয়। সুস্থও হয় তাড়াতাড়ি। ফ্লু, বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো বেশ কিছুর রোগের ভ্যাক্সিন নিয়ে নেওয়ার উপদেশ আমি বাবা-মায়েদের দিই।
তৃতীয়ত, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। স্কুলে গিয়েও যেন হাত ধুয়ে খাবার খায়, হাত না ধুয়ে যেন মুখে-নাকে হাত না দেয়। সিজন চেঞ্জের সময়ে বিভিন্ন ধুলোকণা, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। তার সঙ্গে শরীরের বোঝাপড়া হয়নি তখনও। সেই সময়ে হাত না ধুয়ে নাকে-মুখে হাত দিলে শরীরে প্রবেশ করে সেগুলি। আর তা থেকেই রোগ।
চতুর্থত, পুষ্টিগুণসম্মত খাওয়াদাওয়া। যদি ভিটামিন বা মিনারেল কম থাকে শরীরে, তা হলে বিভিন্ন রোগ দানা বাঁধতে পারে তাড়াতাড়ি। আর ভিটামিনের ওষুধ খেলে একদিনে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় না। তাই ভিটামিন এবং মিনারেল সম্মত খাবার খাওয়ানো খুব দরকার। আর যদি বাচ্চা খাবার খেতে না চায়, তা হলে ভিটমিন সাপ্লিমেন্ট খাওয়াতে হবে। প্রোটিন, ফ্যাট, ফাইবার, সব ধরনের খাবারই খেতে হবে। ফ্যাটও কোনও কোনও সময়ে দরকার। পরিমাণ মতো সবই খেতে হবে, বেশি না। এবং পরিমাণ মতো জল খাওয়াতে হবে বাচ্চাদের।
আরও পড়ুন: আপনার কি আচমকা ওজন বাড়ছে? খেজুর খাওয়া বন্ধ করুন! অবশ্যই জানুন
পঞ্চমত, প্রয়োজন মতো বিশ্রাম নিতে হবে। নার্সারির বাচ্চাদের একটানা ৯-১২ ঘণ্টা ঘুম দরকার। তার পরে ধীরে ধীরে বড় হলে এই সময়সীমাটা কমে যায়। তাও কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা একটানা ঘুমোতেই হবে।
ষষ্ঠত, শরীরচর্চা। ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের মাঠে বা পার্কে খেলতে পাঠানো উচিত। বা নাচ শেখানো, খেলাধুলো শেখানো। এতে শরীরে রক্ত চলাচল ভাল হয়। বিষাক্ত উপাদান শরীর থেকে বেরিয়ে পুষ্টিকর উপাদান শরীরে জমা হবে।
প্রশ্ন: কোভিডের পর থেকে মা-বাবারা তো বাচ্চাদের বাইরে খেলাধুলো করতে দিতে ভয় পাচ্ছেন, উপায়?
ড. নন্দিতা: আমার মতে, ঘরে বসে থাকার চেয়ে বাইরে বেরিয়ে খেলাধুলো করলে বাচ্চাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ বেশি হয়। আমি বলছি না, যে কোভিডের পর প্রবল ভিড়ে বাচ্চাকে পাঠান। কিন্তু চারদিক খোলা মাঠে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে খেলতে যাক, এতে শরীর ও মন ভাল থাকবে। আর সূর্যের আলো পেলে শরীরে ভিটামিন ডি নিজে থেকেই তৈরি হবে।
প্রশ্ন: শিশুরা এই সময়ে অল্প হাঁচি-কাশি শুরু করলে মা-বাবারা ভয় পেয়ে যান, সব সময়ে চিকিৎসকের কাছে ছোটাও সম্ভব নয়, তাঁদের কী বলবেন?
ড. নন্দিতা: বাচ্চাদের হাঁচি-কাশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। যদি না হয়, তা হলে আপনি বুঝতেই পারবেন না, বাচ্চার শরীরে রোগ দানা বেঁধেছে কিনা। এইসব ছোটখাটো উপসর্গ তো লেগেই থাকে। সেক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা যেন ভয় না পেয়ে সতর্ক থাকেন। জ্বরের ওষুধ দিতে হবে, হালকা গরম জল খাওয়াতে হবে। গরম পুষ্টিকর খাবার এই সময়ে উপকার দেয়। দু’এক দিন অপেক্ষা করে দেখতে হবে উপসর্গ বাড়ছে কিনা, যদি তাও বাড়তে থাকে, সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রশ্ন: সিজন চেঞ্জে এই ধরনের সমস্যা দেখা দেয় কেন?
ড. নন্দিতা: সিজন চেঞ্জে তাপমাত্রা বারবার বদল হয়। হয় ঠান্ডা থেকে গরম, বা গরম থেকে ঠান্ডা। নয়তো খুব গরমে বা খুব ঠান্ডায় তাপমাত্রার হেরফের হয় না। একইরকম থাকে। সিজন চেঞ্জ ছাড়া অন্য সময়ে শরীরে একটা তাপমাত্রা সয়ে যায়। সেই তাপমাত্রায় নির্দিষ্ট একটি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া পরিবেশে রয়েছে। তাতে শরীর সয়ে যাচ্ছে। অল্প সর্দি-জ্বর হলেও তা সেরে যায়। কিন্তু যেই তাপমাত্রার হেরফের হয়, আবার নতুন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়। সেটার সঙ্গে শরীরকে সইয়ে নিতে সময় লাগে। যেমন কালীপুজোর সময়ে বাজি ফাটানোর জন্য পরিবেশ দূষণ হয়। তখন আবহাওয়ার যে পরিবর্তন হয়, সেই সময়ে বাতাসে প্রাণহীন অ্যালার্জেন (পোলেন, ডাস্ট) থাকে। তার সঙ্গে আবার জীবিত ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়াও থাকে। আর সে সবই শরীরে প্রবেশ করলে অসুস্থ হয় বাচ্চা থেকে বয়স্করা। শরীরের যেখানে প্রবেশ করে, সেখানেই সমস্যা শুরু হয়।
Dr. Nandita Saha: MBBS (cal), DCH (London), PGPN (Boston)
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Child care, Season Change