#কলকাতা: যাঁরা কেবলমাত্র পাহাড় ভালবাসেন, তেমন বাঙালিদের কাছে পরিচিত উত্তরবঙ্গের ঠিকানা ছেড়ে নেপালের অন্যরকম পাহাড় অনবদ্য অভিজ্ঞতা বয়ে আনতে পারে। আমাদের সফর ছিল সাত দিনের, নেপালের মুক্তিনাথ ভ্রমণের চেনা পথ এত কম দিনে ঘোরা সম্ভব নয়। তাই আমরা ভেবেছিলাম, নেপাল ঘুরব, কিন্তু একটু অন্যরকম করে। হাওড়া থেকে রক্সৌল এক্সপ্রেসে টিকিট কেটে বীরগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে তাই আমরা প্রবেশ করলাম প্রতিবেশী নেপালে। নিয়মের তেমন কোনও কড়াকড়ি নেই। ভারতীয়দের জন্য অবারিত প্রবেশদ্বার। পরিকল্পনা ছিল আমরা প্রথম দিনেই চলে যাব পোখারা, শেয়ার গাড়িতে। কিন্তু সে গাড়ি পাওয়া গেল না। রিজার্ভ গাড়িতে পোখারা যেতে খরচ পড়বে সাত হাজার। তাই ঠিক করলাম, কাঠমাণ্ডুর রিজার্ভ গাড়িতে নেপালের রাজধানীতেই চলে যাই। শুরু হল যাত্রা।
এ ক্ষেত্রে বলে নেওয়া ভাল, নেপালের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা মোটের উপর খারাপ। কিছু কিছু রাস্তা ভাল হলেও একটু শহরের বাইরে বার হলেই রাস্তার বেহাল দশা। হেলতে-দুলতে আমাদের যাত্রা শুরু হল কাঠমাণ্ডুর উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ রাস্তা! সকাল ১১টায় যাত্রা শুরু করে আমাদের কাঠমাণ্ডু পৌঁছতে বেজে গেল প্রায় সাড়ে পাঁচটা। গাড়ি ভাড়া পড়ল শেয়ারে মাথাপিছু ৬০০ টাকা। কাঠমাণ্ডু চমৎকার জায়গা, লোকে লোকারণ্য, গাড়ি-ঘোড়া, সর্বত্র জমজমাট। কিন্তু কলকাতার ভিড় ছেড়ে সেই শহরের উষ্ণতা আমাদের কাছে তেতো ঠেকল। তাই ঠিক করলাম, কাঠমাণ্ডু থেকে ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরে নাগারকোটে চলে যাব এই দিনই। সন্ধ্যা ছটার সময় শুরু হল নাগারকোটের যাত্রা। গাড়ি ভাড়া নেপালের টাকায় ২৫০০, ভারতীয় টাকায় ১৬০০ মতো। আবার সেই বেহাল রাস্তা, আবার সেই গাড়ির মধ্যে বসে বসে অসহ্য দুলুনি। দীর্ঘ যাত্রার কারণে শরীর আর যেন চলছিল না, তবু, বেড়াতে আসা বলে কথা।
ধীরে ধীরে শহরের ভিড় কমে এল। অন্ধকার নেমে এল রাস্তায়। গাড়ি চলতে শুরু করল ধীরে ধীরে। এর মধ্যে শুরু হল বৃষ্টি। মিশকালো অন্ধকার রাস্তায় প্রাণ হাতে বসে রইলাম আমরা। তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় ৯টা ছুঁই-ছুঁই। নাগারকোটের হোটেল বলে দিয়েছে, নটার পর আর থাকার জায়গা দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা তখন উৎকণ্ঠায়, ভয়ে কাঁটা হয়ে আছি। তথন হোটেলের এক কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছি, হঠাৎ পাহাড়ের চড়াইয়ের রাস্তায় গাড়ির ইঞ্জিন থেমে গেল। সে আর কিছুতেই স্টার্ট হয় না। আমাদের তো তখন কলজে গলায় উঠে এসেছে। অন্ধকারে অত লাগেজ নিয়ে পাহাড়ের চড়াই রাস্তায় যাওয়া এক কথায় অসম্ভব। গাড়ি না গেলে কী হবে!
যে হোটেলে রইলাম।
বেশ কয়েকবার, কয়েক হাত যেতে যেতেই ইঞ্জিন বন্ধ হল, আবার চলল। এমন করতে করতে নটা পাঁচ নাগাদ আমরা হোটেলের দরজায় ঢুকলাম। সবাইকে ফেলে আমি ছুটে গেলাম হোটেলের রিসেপশনে। তখন লাইট বন্ধ করতে শুরু করেছেন হোটেলের কর্মীরা। বললাম সবটা। হোটেলের ম্যানেজার হেসে বললেন, ঠিক আছে, ঘর দেখাচ্ছি। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। নাগারকোটের প্রায় শেষ প্রান্তে, এই মনমুগ্ধকর হোটেল দ্যা হোটেল অ্যাট দ্যা এন্ড অফ দ্যা ইউনিভার্স। সেখানে আমরা চারজন একটা ভিলা নিলাম, সঙ্গে ডিনার ও ব্রেকফাস্টের প্যাকেজ, চার জনের মাথা পিছু দৈনিক নেপালি টাকায় ২৩০০ করে, ভারতীয় টাকায় তা ১৪৩৭ টাকা মতো। আমরা রয়ে গেলাম সেই ঘরে।
নাগারকোটের এই হোটেল থেকে একাধিক বরফে মোড়া পাহাড় দেখা যায়। আমাদের ঘরের সামনেই বিস্তৃত বারান্দা। সেখানে দাঁড়ালেই পাহাড় দেখতে পাওয়ার কথা। কিন্ত পাহাড় দেখা কপালে না থাকলে কী আর দেখা যায়। পরের দিন থেকে সারাক্ষণ ঢেকে রইল সেই পাহাড়। আমরা খাচ্ছি, ঘুরছি, কয়েক পা হেঁটে পাওয়া জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে আরাম করে বসে আছি। কিন্তু পাহাড়ের দেখা নেই। আমরা দু-রাত্তিরের জন্য এখানে থাকা ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আমাদেরই এক সঙ্গীর কর্মস্থলের হঠাৎ এক বিপদ উপস্থিত। সে বিপদ এড়ানো মুশকিল, থাকতে হবে ওয়াই-ফাই জোনে। তাই আরও এক রাত থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। তবে তাতে যে শাপে বর হবে, তা আমরা আন্দাজ করিনি।
বিকেলে সূর্যাস্তের ঠিক আগে, বৃষ্টি ধোয়া পাহাড়ের দিগন্ত ভেদ করে হঠাৎ দেখা দিল বরফে মোড়া শৃঙ্গ।
নাগারকোট নেপালের পূর্ব দিকে, বেশ উঁচু। রোজই সেই পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে যায় ঝড়ো হাওয়া। বিশেষত বিকেল পড়লেই হাওড়া বাড়ে, বৃষ্টিও হয়। আমারা পৌঁছেছিলেন ১৯ এপ্রিল, ২০ এপ্রিল থাকার কথা ছিল, কিন্তু রইলাম অতিরিক্ত আরও এক দিন, অর্থাৎ ২১ এপ্রিল। আর সে দিনই দুপুরের পর থেকেই হঠাৎ শুরু হল ভয়ঙ্কর ঝড়। শুরু হল বৃষ্টি। সে তুমুল বৃষ্টিতে কার্যত ধুয়ে গেল পাহাড়া। কিন্তু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল অনন্য সুন্দর হিমালয়। বিকেলে সূর্যাস্তের ঠিক আগে, বৃষ্টি ধোয়া পাহাড়ের দিগন্ত ভেদ করে হঠাৎ দেখা দিল বরফে মোড়া শৃঙ্গ। যা দেখতে এসেছিলাম, হঠাৎই দেখতে পেয়ে গা কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে হল রোদের সোনা কেউ হাতে করে লেপে দিয়েছে হিমালয়ের গায়ে। সামান্য ওপরে কালো মেঘ, আর দূরে বরফে মোড়া পাহাড়! যূগলেরা তখন ওই স্বর্গের বারান্দার দাঁড়িয়ে আলিঙ্গন করছে একে অপরকে, উচ্ছ্বসির হোটেল মালিক আঙুল দিয়ে চিনিয়ে দিচ্ছেন শৃঙ্গগুলি! এই দেখতেই তো এত কষ্ট। কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি, আমাদের মন ভোলাতে অপেক্ষা করছে প্রাণের শহর পোখারা।
(পর্ব ১ সমাপ্ত)
নিউজ১৮ বাংলায় সবার আগে পড়ুন ব্রেকিং নিউজ। থাকছে দৈনিক টাটকা খবর, খবরের লাইভ আপডেট। সবচেয়ে ভরসাযোগ্য বাংলা খবর পড়ুন নিউজ১৮ বাংলার ওয়েবসাইটে।
Tags: Travel